![]() |
কখনো কখনো দেখা যায়, বিয়ের পর স্ত্রী বাবার বাড়িতে এসে স্বামীর সংসারে
ফিরতে চান না। আবার স্ত্রীকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে স্বামী আর তার সংসারে
ফিরিয়ে নিতে চান না। এটা আমাদের সমাজের একটি বাস্তব চিত্র। তবে স্ত্রী সংগত
কারণ ছাড়া যদি স্বামীর সাথে বসবাস বন্ধ করে দেন সেক্ষেত্রে স্বামী
দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে
পারেন। (মুন্সী বজলুর রহিম বনাম সামসুন্নেসা বেগম, ১৮৬৭, ১১ এম.আই.এ.
পৃষ্ঠা-৫৫১)। এ অবস্থায় অনেকে আবার তালাকও দিয়ে দেন। কিন্তু সেই তালাক
কার্যকর হওয়ার আগে পারিবারিক আদালতের অধ্যাদেশ ১৯৮৫-এর বলে স্বামী বা
স্ত্রীকে দাম্পত্য সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা মামলা করতে হয়।
দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতার
ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে যিনি মামলাটি করেন তাঁকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে,
তিনি স্বচ্ছ মনোভাব নিয়েই আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন এবং প্রমাণ করতে হবে যে,
তাঁর জীবনসঙ্গীনী কোনো কারণ ছাড়াই ঘরে ফিরতে চান না। তবে স্বামী বা
স্ত্রীর মধ্যে তালাকপ্রক্রিয়া সম্পন্নকালে তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার করা না
হলে এ মামলা চলে না। (মুলখান বিবি বনাম ওয়াজির খান, ৫৯, পি.লাহ.
পৃষ্ঠা-৭১০)।
এ মামলায় আদালত বিবেচনা করবেন যে, স্বামী বা স্ত্রী পরস্পরের প্রতি
আরোপিত দায়িত্ব পালন করছেন কি-না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্ত্রীর পক্ষে
স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে ঘরে ফেরা সম্ভব নয়। এ রকম হলে তালাক নেওয়ার
ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছে তা প্রমাণ করতে
পারলে স্বামী অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। আবার স্বামী যদি স্ত্রীর বিরুদ্ধে
ব্যভিচারের অভিযোগ সত্য প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে দাম্পত্য অধিকার
পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আদালত আদেশ বা ডিক্রি জারি করতে পারেন। (মোছা. মকবুলান বনাম
রমজান, ১৯২৭, ২ লাক. পৃষ্ঠা-৪৮২)
তবে স্বামী যদি সমাজচ্যুত কোনো
কুখ্যাত সন্ত্রাসী বা মাস্তান হন, সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর বিরুদ্ধে দাম্পত্য
অধিকার মামলা চলে না এবং স্ত্রী স্বামীর ঘরে ফিরতে বাধ্য নন। এ ছাড়া
তাৎক্ষণিক দেনমোহর পরিশোধ করা না হলে স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য মিলনে
অস্বীকৃতি জানাতে পারেন স্ত্রী। এ ক্ষেত্রে স্বামী যদি দাম্পত্য অধিকার
ফিরে পেতে মামলা করেন, তাহলে আনীত মামলাটি নাকচ করা হবে। (রাহিলান বনাম
সানাউল্ল্যা, ১৯৫৯, পি.লাহ. পৃষ্ঠা-৪৭০)। আর স্বামী-স্ত্রীর ঘরসংসার করার
ইচ্ছে থাকা সত্তে¡ও যদি শ্বশুরবাড়ির লোকজন এতে বাধা দেয়, তাহলে ফৌজদারি
আদালতের আশ্রয় নেওয়া যায়। ফৌজদারী কার্যবিধি, ১০০ ধারার বিধান অনুযায়ী
তল্লাশি পরোয়ানার মামলা করে বন্দিদশা থেকে স্ত্রীকে মুক্ত করানো সম্ভব।
তবে এ মামলায় দু’টি ব্যতিক্রম রয়েছে: ক. বিবাহটি স্ত্রীর ইদ্দতকালে
অনুষ্ঠিত হলে, দাম্পত্য মিলন ঘটে থাকলেও ¯¦ামী দাম্পত্য অধিকার
পুনরুদ্ধারের জন্য কোন আদেশ বা ডিক্রি পাবেন না । খ. স্ত্রীর নাবালকত্বকালে
বিবাহটি সম্পন্ন হওয়ার পর যদি বৈধভাবে তার বিচ্ছেদ ঘটে থাকে তাহলে স্বামী
তার বিরুদ্ধে কোনো ডিক্রি পাবেন না ।
স্ত্রী নিম্নোক্ত কারণে স্বামীর
দাম্পত্য অধিকার পূণরুদ্ধারের দাবি অস্বীকার করে বিপরীত দাবি করতে পারেন।
যথাক্রমে- ক. স্বামীর নিষ্ঠুরতা, খ. স্বামী হতে পৃথক থাকার ক্ষমতা দান, গ.
আশু মোহরানা পরিশোধ না করা, ঘ. স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামী কর্তৃক মিথ্যা
অভিযোগ আনয়ন, ঙ. স্বামীকে সমাজচ্যুতকরণ, চ. বিবাহের মিথ্যা দাবি
সংক্রান্তমামলা, ছ. ওয়াদা ভঙ্গের দাবি ও জ. স্ত্রী অপহরণ
দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবির ক্ষেত্রে আইনবিদদের মধ্যে দ্বিমত
রয়েছে। বিভিন্ন মামলার নজিরেও ভিন্নমত পাওয়া গেছে। এতে অভিযোগ উঠেছে, কেউ
যদি স্বাধীনচেতা হন, পূর্ণাঙ্গভাবে আলাদা থাকতে চান এতে সংবিধানের ২৭, ৩১ ও
৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একতরফা দাবির কোনো
সংঘাত হবে কি-না। ১৮ বিএলডি, ১৯৯৮, হাইকোর্ট, পৃষ্ঠা ৩১-এ খোদেজা বেগম বনাম
মো. সাদেক মামলার রায়ে বলা হয়েছে, ‘দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য একটি পারষ্পরিক অধিকার। সংবিধানের কোনো
অনুচ্ছেদের সঙ্গে এটি বৈষম্যমূলক কিংবা অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’ হোসেন জাহান
বনাম মো. সাজাহান মামলায় (১৮ বিএলডি, ১৯৯৮, হাইকোর্ট, পৃষ্ঠা-৩২১) বলা হয়,
‘বিনা কারণে যদি কোনো স্ত্রী দাম্পত্য মিলনে অস্বীকার করেন তাহলে স্বামী
মামলা করতে পারেন।’
আরেকটি মামলার (১৬ বিএলডি, ১৯৯৬ পৃষ্ঠা ৩৯৬-৩৯৮) লিপিবদ্ধ বর্ণনায় নিম্ন
আদালত থেকে স্বামীর পক্ষে ডিক্রি এবং আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে স্ত্রী রিভিশন
মামলা করলে হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চ (বিচারপতি গোলাম রব্বানী ও বজলুর
রহমান তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত) এ ডিক্রি বাতিল করেন এবং দাম্পত্য অধিকার
মোকদ্দমা ডিস্মিস করেন। ওই রায়ে সৈয়দ আমির আলীর মোহামেডান ‘ল’ গ্রন্থ থেকে
বিয়ের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করা হয় এবং বলা হয়,
‘কোনো দেওয়ানি বা ধর্মীয় আইনের চোখে ইসলামী আইন অধিক কঠোর, যা একজন
মহিলাকে তাঁর বিবাহিত জীবনের অত্যাচার থেকে রক্ষা করে। ইসলামি আইনে এ
অত্যাচার স্বামী কর্তৃক কেবল দৈহিক বা মানসিক অত্যাচার বোঝায় না, স্বামীর
সঙ্গে বসবাসে স্ত্রীর অনিচ্ছুকতাও বোঝায়।’ অপর একটি বেঞ্চ সিদ্ধান্তে বলেন
যে, দাম্পত্য সম্পর্ক পূনরুদ্ধারের অধিকার স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার
এবং এটি পক্ষপাতমূলক নয় কিংবা সামাজিক ন্যায়বিচার লংঘন নয়; এমনকি
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। (চান মিয়া বনাম রুপনাহার, ১৮
বিএলডি, হাইকোর্ট, পৃষ্ঠা-৩২৯)।
দাম্পত্য পুনরুদ্ধার মোকদ্দমার ক্ষেত্রে স্বামীরা এ প্রতিকার বেশি
চাইলেও ৯০ শতাংশ ডিক্রিই স্ত্রীর পক্ষে যায়। আর এ ধরনের প্রতিকার স্বামী বা
স্ত্রীকে দাম্পত্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডিক্রি কোনো পক্ষ পেলেও
সাধারণত ডিক্রি কার্যকর হয় না। এ ডিক্রি প্রাপ্তির ফলে কেবল স্বামী বা
স্ত্রীর উপর দাম্পত্য অধিকারটি স্থাপিত করা যায়, যাতে অপর পক্ষ দ্বিতীয়
বিয়ে কিংবা বিনা কারণে তালাক না চান। তবে তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপরে জোর
করা যায় না। এতে সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকার লংঘিত হয়। তবে কেউ যদি
তালাক চান, তাহলে আলাদাভাবে তা কার্যকর করতে হবে। আর স্বামী-স্ত্রীর
ঘর-সংসার করার ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও যদি শ্বশুরবাড়ির লোকজন এতে বাধা দেয়,
তাহলে ফৌজদারী আদালতের আশ্রয় নেওয়া যায়।
দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার মামলা করার নিয়মাবলী
মূলত ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের ৫নং ধারার বিধান মতে, একজন
ক্ষতিগ্রস্ত নারী পাঁচ বিষয়ে দেওয়ানী মামলা করার অধিকার প্রাপ্ত হন। তার
মধ্যে পারিবারিক আদালতে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারে মামলা আরজি দাখিলের
মাধ্যমে করতে হয়। পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৬ মতে, সাধারণত এ সব
মামলার একটি আরজিতে নিম্নোক্ত বিষয় উল্লেখ থাকতে হয়।
১। যে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে তার নাম, ২। বাদীর নাম, বিবরণ ও
বাসস্থানের ঠিকানা, ৩। বিবাদীর নাম, বিবরণ ও বাসস্থানের ঠিকানা, ৪। বাদী বা
বিবাদী শিশু বা অসুস্থ-মনের অধিকারী হলে সেই বিষয়ের বিবৃতি, ৫। মামলা
দায়ের করার কারণ এবং এই কারণ উদ্ভব হওয়ার স্থান ও তারিখ, ৬। আদালতের যে
এখতিয়ার আছে তার বর্ণনা এবং ৭। বাদী যে প্রতিকার দাবি করেছে তার পরিষ্কার
বিবরণ।
উল্লেখিত সাতটি বিষয় বিস্তারিতভাবে আরজিতে উল্লেখ থাকতে হবে এ মামলায়।
পাশাপাশি পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫-এর ২২ ধারার বিধান মতে, পারিবারিক
আদালতে উপস্থিত যে কোনো মামলার আরজির জন্য প্রদেয় কোর্ট ফি’র পরিমাণ হবে
পঁচিশ টাকা।
লেখক: অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী আইনগ্রন্থ প্রণেতা
0 Comments